বিদ্যুতের চৌম্বক ক্রিয়া(Magnetic Effects of Current)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পদার্থবিজ্ঞান - NCTB BOOK

আমরা সবাই আমাদের জীবনে কখনো না কখনো চুম্বকের আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ দেখে চমৎকৃত হয়েছি। আপাতদৃষ্টিতে চৌম্বকত্ব এবং বিদ্যুৎ প্রবাহকে পুরোপুরি ভিন্ন দুটি বিষয় বলে মনে হলেও এই দুটোই যে একই শক্তির ভিন্ন রূপ সেটি এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। আমরা দেখব বিদ্যুতের প্রবাহ হলে যেরকম চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে ঠিক সেরকম চৌম্বক ক্ষেত্রকে পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা যেতে পারে। 

এই অধ্যায়ে বিদ্যুতের চৌম্বক ক্রিয়ার সাথে সাথে কীভাবে চুম্বক এবং বিদ্যুৎকে ব্যবহার করে নানা ধরনের বজ্রপাতি তৈরি করা হয় এবং ব্যবহার করা হয় সেই বিষয়গুলোও আলোচনা করা হয়েছে। 

 

Content added By
Content updated By

তোমরা সবাই নিশ্চয়ই চুম্বক দেখেছ, একটা চুম্বক লোহাজাতীয় পদার্থের কাছে আনলে সেটা লোহাকে আকর্ষণ করে। চুম্বক এবং লোহার মাঝখানে কিছু নেই কিছু একটা অদৃশ্য শক্তি সেটাকে টেনে আনছে। সেটি প্রথমবার দেখার পর সবারই এক ধরনের বিস্ময় হয়। যাৱা দুটি চুম্বক হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পেয়েছ তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ(চিত্র12.01) যে চুম্বকের দুটি মেরু এব মেরু দুটি এক ধরনের হয়ে থাকে তাহলে সেটা বিকর্ষণ করে আর মেরু দুটি যদি ভিন্ন ধরনের হয় তাহলে আকর্ষণ করে। চুম্বকের মেরু দুটিকে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু নাম দেওয়া হয়েছে। কারণ দেখা গেছে একটা চুম্বককে ঝুলিয়ে দিলে সেটা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর থাকে, যে অংশটুকু উত্তর দিকে থাকে সেটার নাম উত্তর মেরু, যেটা দক্ষিণ দিক বরাবর থাকে সেটা দক্ষিণ মেরু। এটা ঘটে তার কারণ পৃথিবীর একটা চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, কোনো চুম্বক ঝোলালে সেই ক্ষেত্র বরাবর চুম্বকটা নিজেকে সাজিয়ে নেয়। দুটো চুম্বক কেমন করে একে অন্যকে আকর্ষণ করে আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেই পারি কিন্তু সবার আগে জানা দরকার চুম্বকের যে বল, সেটা আসে কোথা থেকে? 

 

Content added By
Content updated By

বিদ্যুতের চৌম্বক ক্রিয়া(Magnetic Effects of Current)

যারা সাধারণভাবে চুম্বক হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে তারা নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারবে না যে এটি তড়িৎ বা বিদ্যুৎ থেকে আলাদা কিছু নয় এবং তড়িৎ বা বিদ্যুতের প্রবাহ দিয়ে চুম্বক তৈরি করা যায়। একটা চার্জ থাকলে তার পাশে যেমন তড়িৎ ক্ষেত্র থাকে ঠিক সে রকম একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে সেই তারের চারপাশে চৌম্বক

 ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধরা যাক তুমি একটা কার্ডবোর্ডের মাঝখান দিয়ে একটা তার ঢুকিয়েছ এবং কার্ডের ওপর অনেকগুলো ছোট ছোট কম্পাস রেখেছ(চিত্র 12..02)। কম্পাসগুলো অবশ্যই উত্তর-দক্ষিণ বরাবর থাকবে ঠিক যে রকম থাকার কথা। এখন যদি এই তারের ভেতর দিয়ে কোনোভাবে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহিত করতে পারো (মোটামুটি শক্তিশালী) তাহলে তুমি অবাক হয়ে দেখবে হঠাৎ করে সবগুলো কম্পাস একটা আরেকটার পেছনে সারিবদ্ধভাবে নিজেদের সাজিয়ে নেবে। তোমার স্পষ্ট অনুভুতি হবে যে এই বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য তারকে ঘিরে একটা বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তুমি যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে দাও তাহলে আবার সবগুলো ছোট ছোট কম্পাস উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হয়ে যাবে। এবারে তুমি যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পাল্টে দাও তাহলে দেখবে আবার কম্পাসগুলো নিজেদের সাজিয়ে নেবে কিন্তু এবারে বৃত্তটায় কম্পাসের দিকটা হবে উল্টো দিকে। তার কারণ বিদ্যুৎ প্রবাহ সব সময় তাকে ঘিরে একটা নির্দিষ্ট দিকে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। 

একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার জন্য তৈরি হওয়া চৌম্বক বলরেখাগুলোর দিক কোন দিকে হবে সেটা ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটা যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায় তাহলে হাতের অন্য আঙুলগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকটি নির্দেশ করে (চিত্র 12.03)। 

                       

                                

Content added By
Content updated By

একটা তারের ভেতর দিয়ে কতখানি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা যায় তার একটা সীমা আছে, তারটা I I2R হিসেবে পরম হয়ে যায় তা ছাড়াও সবচেয়ে বেশি কতখানি বিদ্যুৎ প্রবাহ দেওয়া সম্ভব সেটা বিদ্যুতের উৎসের ওপর নির্ভর করে। তাই যদি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে হয় তাহলে একটা মাত্র বৃত্তাকার লুপ-এর ওপর নির্ভর না করে অপরিবাহী আস্তরণ দিয়ে ঢাকা তার দিয়ে অনেকবার প্যাঁচিয়ে একটা কুণ্ডলী বা কয়েল তৈরি করা হয়। এরকম কুণ্ডলীকে বলে সলিনয়েড। সেই কুণ্ডলী দিয়ে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। কয়েলের প্রত্যেকটা সুপই তার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুতের জন্য চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করবে, তাই সম্মিলিত চৌম্বক ক্ষেত্র হবে অনেক গুণ বেশি। 

বৃত্তাকার তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার চৌম্বক ক্ষেত্র কোন দিকে হবে সেটাও ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটি হবে চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক যদি অন্য আঙুলগুলো বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায়। একটা তারের কুণ্ডলী বা সনিয়েড আসলে দণ্ড চুম্বকের মতো কাজ করে এবং বুড়ো আঙুলের দিকটা হবে এই চুম্বকের উত্তর মেরু । 

একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে তার জন্য তৈরি হওয়া চৌম্বক বলরেখাগুলোর দিক কোন দিকে হবে সেটা ডান হাতের নিয়ম দিয়ে বের করা যায়। বুড়ো আঙুলটা যদি বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক দেখায় তাহলে হাতের অন্য আঙুলগুলো চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকটি নির্দেশ করে। 

Content added By
Content updated By

তড়িৎ প্রবাহী তারের ওপর চুম্বকের প্রভাব

আমরা জানি, একটা চুম্বক অন্য চুম্বকের সমমেরুতে বিকর্ষণ এবং বিপরীত মেরুকে আকর্ষণ করে। আবার একটা তারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে সেটি তাকে ঘিরে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। কাজেই একটা চৌম্বক ক্ষেত্রে যদি একটা তার রাখা হয় এবং সেই ভারের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয় তাহলে তারটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করার কারণে একটি বল অনুভব করে।

চিত্র 12.09: চৌম্বক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্রবাহী তার রাআখা হলে সেটি বল অনুভব করে

12.09 চিত্রে একটা চুম্বকের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া চৌম্বক বলরেখা এবং তার মাঝে একটা তারকে দেখানো হয়েছে, তারটি কাগজের ভেতর থেকে উপরের দিকে বের হয়ে এসেছে। তারের ভেতর দিয়ে নিচ থেকে উপরে বিদ্যুৎ প্রবাহ হলে এটি তাকে ঘিরে বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করবে এবং উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত হয়ে চৌম্বক বলরেখাকে পুনর্বিন্যাস করবে। তারের নিচে বেশিসংখ্যক চৌম্বক বলরেখা এবং উপরে কমসংখ্যক চৌম্বক বলরেখার তৈরি হবে, যেটি ভারটিকে উপরের দিকে ঠেলে দেবে। যদি তারটিতে বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করা হয় তাহলে তারকে ঘিরে বৃত্তাকার চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক পাল্টে যাবে এবং তখন তারের ওপর চৌম্বক বলরেখার ঘনত্ব বেড়ে যাবে যেটি তারটিকে নিচের দিকে ঠেলে দেবে। 

Content added By
Content updated By

তোমরা জান একটি চুম্বক দিয়ে অন্য চুম্বকের উপর বল প্রয়োগ করা যায়। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি একটি চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা যায়। একটি তারের ভেতর দিয়ে খুব বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা যায় না, তাই সেটি খুব বড় চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে না। কাজেই অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে তার ওপর শক্তিশালী বল প্রয়োগ করা যায় না। তোমরা দেখেছ যদি অনেকগুলো পাক দিয়ে একটা তারের কুণ্ডলী তৈরি করা যায় এবং তার ভেতরে একটা লোহার টুকরো বা আর্মেচার রাখা হয় তাহলে তারের ভেতর হালকা বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হলেই সেটি একটি তাড়িতচুম্বক বা ইলেকট্রোম্যাপনেট হয়ে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এই কয়েলকে আমরা একটা দণ্ড চুম্বক হিসেবে কল্পনা করে অন্য চৌম্বক ক্ষেত্রে তাকে রাখা হলে সেটি কী ধরনের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মুখোমুখি হবে এবং সে কারণে সেটির কোন দিকে গতি হবে সেটা বিশ্লেষণ করতে পারি। 12.10 চিত্রে এ রকম একটা তাড়িতচুম্বককে অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্রে বিকর্ষণ বলের কারণে কীভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করবে সেটি দেখানো হয়েছে।তাড়িতচুম্বকটিকে যদি তার কেন্দ্র বরাবর একটা অক্ষে ঘুরতে দেওয়া হয় তাহলে এটি পরের চিত্রের মতো অবস্থানে যাবার চেষ্টা করবে। 

চিত্র 12.10 : বৈদ্যুতিক মোটর একটি তাড়িতচুম্বকের ভেতর দিয়ে এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ করানো হয়, যেন সব সময়েই এটি ঘুরতে থাকে

 

যদি কোনো বিশেষ অবস্থা তৈরি করে পরের অবস্থানে যাবার সাথে সাথে তাড়িতচুম্বকটির বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করে দেওয়া যায় তাহলে সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে কয়েল দিয়ে তৈরি দণ্ড চুম্বকটির উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুতে আর দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুতে পাল্টে যাবে, তাই বিকর্ষণের কারণে আবার সেটি সরে যাবার চেষ্টা করবে অর্থাৎ এটি একটি ঘূর্ণন বল অনুভব করবে। এটি চেষ্টা করবে পরের স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাতে কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে আবার এটার বিদ্যুতের দিক পরিবর্তন করে দিলে এটি সেখানে থেমে যাবে না, আবার ঘুরতে শুরু করবে। তাই যখনই এটা একটা স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাবে তখনই যদি এটাতে এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ করানো হয় যেন বিকর্ষণের কারণে এটি একটি ঘূর্ণন বল অনুভব করে তাহলে এটি ঘুরতেই থাকবে। 

বিদ্যুতের দিক পরিবর্তন করার জন্য কম্যুটেটর নামে একটি উপকরণের মাধ্যমে খানিকটা যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হয়। মূল কয়েল যে অক্ষে ঘুরতে থাকে সেই ঘূর্ণায়মান অক্ষটির দুই পাশে তড়িৎ চুম্বকের দুটি তার এমনভাবে বসানো হয় যেন সেটি কম্যুটেটরে মূল বিদ্যুৎ প্রবাহের টার্মিনালকে স্পর্শ করে থাকে। যখনই স্পর্শ করে তখনই এমনভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করবে যেন সব সময়ই সেটি তাড়িতচুম্বক টিঁকে বিকর্ষণ করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মাঝামাঝি সময়ে যখন এটি মূল বিদ্যুৎ প্রবাহের টার্মিনাল থেকে সরে যাওয়ার কারণে তাড়িতচুম্বকটিতে কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় না তখনো এটি থেমে না গিয়ে গতি জড়তার কারণে ঘুরতে থাকে । 

 

Content added By
Content updated By

তাড়িতচুম্বক(Electromagnet)

শুধু বিদ্যুৎ ব্যবহার করে যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যায় তার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব যদি এই কুগুলীর ভেতর এক টুকরো লোহা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। লোহা, কোবাল্ট আর নিকেল এই তিনটি ধাতুর বিশেষ চৌম্বকীয় ধর্ম আছে। এগুলোকে এলোমেলোভাবে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট চুম্বক হিসেবে কল্পনা করা যায়। যেহেতু সবগুলো ছোট চুম্বক এলোমেলোভাবে আছে তাই পুরো লোহার টুকরোটা কোনো চুম্বক হিসেবে কাজ করে না।কিন্তু যখন এটাকে একটা কয়েল বা মলিনয়েডের মাঝে ঢোকানো হয় এবং সেই সলিনয়েডে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয় তখন সেটা যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে সেটা লোহার টুকরার ছোট ছোট চুম্বকগুলোকে সারিবদ্ধ করে ফেলে তাই বিদুৎ প্রবাহের জন্য তৈরি চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে সাথে লোহার নিজন্য চৌম্বক ক্ষেত্র একত্র হয়ে অনেক শক্তিশালী একটা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করার সাথে সাথে লোহার টুকরোর ভেতরকার সারিবদ্ধ ছোট ছোট চুম্বকগুলো সব আবার এলোমেলো হয়ে যাবে এবং পুরো চৌম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য হরে যাবে। 

এভাবে তৈরি করা চুম্বককে বলা হয় তাড়িতচুম্বক । তাড়িতচুম্বকের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই। স্পিকারে বা এয়ারফোনে যে শব্দ শোনা যায় সেখানে তাড়িতচুম্বক ব্যবহার করা হয়।(চিত্র12.08 )এখানে শব্দের কম্পন এবং তীব্রতার সমান বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠানো হয়, সেই বিদ্যুৎ একটা তাড়িতচুম্বক বা ইলেকট্রোম্যাগনেটের চৌম্বকত্ব শব্দের কম্পন বা ভীব্রতার উপযোগী করে তৈরি করে সেটা একটা ডায়াফ্রামকে কাঁপায় এবং সেই ডায়াফ্রাম সঠিক শব্দ তৈরি করে। 

Content added By
Content updated By

তাড়িতচৌম্বক আবেশ

আমরা আমাদের চারপাশে অসংখ্য যন্ত্রপাতিকে ঘুরতে দেখি, তাই আমাদের মনে হতে পারে এটাই বুঝি চুম্বক এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় অবদান। আসলে চুম্বকের এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় অবদান কিন্তু তার তাড়িত আবেশ অর্থাৎ চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা। বিজ্ঞানী ওয়েরস্টেড প্রথমে দেখিয়েছিলেন কোনো একটা পরিবাহী তারের লুপের ভেতর যদি চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করা হয় তাহলে সেই লুপের ভেতর তড়িচ্চালক শক্তি (EMF) তৈরি হয়, যেটা সেই লুপের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করতে পারে। এই বিষয়টি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ জেনারেটর তৈরি করা হয়েছে, যেখানে পরিবাহী তারের ভেতর দিয়ে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। 

একটা কয়েলের দুই মাথা যদি একটা অ্যামিটারে লাগানো হয় এবং যদি সেই কয়েলের ভেতর একটা দত্ত চুম্বক ঢোকানো হয় (চিত্র12.12) তাহলে আমরা ঠিক ঢোকানোর সময় অ্যামিটারে এক ঝলক বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখতে পাব। আমরা যখন চুম্বকটা টেনে বের করে আনব তখন আবার আমরা অ্যামিটারে এক ঝলক বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখৰ তবে এবারে উল্টো দিকে। আমরা যদি চুম্বকের মেরু পরিবর্তন করি তাহলে অ্যামিটারেও বিদ্যুতের দিক পরিবর্তন দেখতে পাবা সুতরাং আমরা বলতে পারি একটি তারের কুণ্ডলীতে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করার সময় কুণ্ডলীর ভেতর ডোস্টেজ এবং বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি করাকে তাড়িতচৌম্বক আবেশ বলে। এই ভোল্টেজকে আবিষ্ট ডোস্টেজ এবং বিদ্যুৎ প্রবাহকে আবিষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহ বলে।এই পরীক্ষাটি করার সময় আমরা কয়েলের ভেতর চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন করার জন্য একটা চুম্বককে কয়েলের ভেতর নিয়েছি এবং বের করে এনেছি। আমরা অন্য কোনোভাবে চৌম্বক ক্ষেত্ৰ পরিবর্তন করতে পারতাম তাহলেও আমরা একই বিষয় দেখতে পেতাম। কয়েলের ভেতর চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন করার আরেকটা উপায় হচ্ছে, এর কাছে চুম্বকের বদলে দ্বিতীয় একটা কয়েল নিয়ে আসা এবং সেই কয়েলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করিয়ে সেখানে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা। যদি দ্বিতীয় কয়েলটিতে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য একটা ব্যাটারিকে একটা সুইচ দিয়ে সংযোগ দেওয়া হয় তাহলে সুইচটি অন করে দ্বিতীয় কয়েলে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যাবে, আবার সুইচটি অফ করে চৌম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য করে দেওয়া যাবে। প্রথম কয়েলটির কাছে দ্বিতীয় কয়েলটি রেখে যদি সেটিতে চৌম্বক ক্ষেত্র একবার তৈরি করা হয় এবং আরেকবার নিঃশেষ করা হয় তাহলে প্রথম কয়েলের ভেতর চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হবে এবং আমরা অ্যামিটারে সেজন্য বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখব। সুইচ অন করে যখন বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করা হবে তখন অ্যামিটারের একদিকে তার কাঁটাটি নড়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখাবে—সুইচটি অফ করার সময় আবার কাঁটাটি অন্যদিকে নড়ে বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেখাবে! 

এখানে যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, যখন চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন হয় শুধু তখন বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়। একটা কয়েলের মাঝখানে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা চুম্বক রেখে দিলে কিন্তু কয়েল দিয়ে কোনো বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে না। শুধু যখন চুম্বকটি নাড়িয়ে চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন করা হবে তখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে। 

Content added By
Content updated By

মোটর কীভাবে কাজ করে সেটা যখন আমরা বোঝার চেষ্টা করছিলাম তখন দেখেছি সেখানে একটা চৌম্বক ক্ষেত্রের মাঝে একটা তাড়িতচুম্বকের ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহ করানো হয়, যে কারণে সেটা ঘোরে। এবারে ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে চিন্তা করা যাক, মোটরের তাড়িতচুম্বকের দুই প্রান্তে যদি আমরা ব্যাটারি সেলের সংযোগ না দিয়ে সেখানে একটা অ্যামিটার লাগিয়ে তাড়িতচুম্বকটা ঘোরাই তাহলে কী হবে? 

অবশ্যই তখন কয়েলের মাঝে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হবে, কাজেই কুণ্ডলীর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ হবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহ করিয়ে যে মোটরের তাড়িতচুম্বক বা কয়েলকে আমরা ঘুরিয়েছি, সেই তাড়িতচুম্বক বা কয়েলটিকে ঘোরালে ঠিক তার উল্টো ব্যাপারটা ঘটে, বিদ্যুৎ তৈরি হয়। এভাবেই জেনারেটর তৈরি হয়। অর্থাৎ ডিসি মোটরের আর্মেচারকে ঘোরালে সেটা ডিসি বিদ্যুৎ প্রবাহ দেয়, এসি মোটরকে ঘোরালে ঠিক সেভাবে এসি বিদ্যুৎ প্রবাহ দেয়। 

Content added || updated By

চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হলে বিদ্যুৎ তৈরি হয় এটি ব্যবহার করে ট্রান্সফর্মার তৈরি করা হয়। ট্রান্সফর্মার কীভাবে কাজ করে বোঝার জন্য 12.13 চিত্রে একটা আয়তাকার লোহার মজ্জা বা কোর দেখানো হয়েছে। এই কোরের দুই পাশে পরিবাহী তার প্যাঁচানো হয়েছে অবশ্যই এই পরিবাহী তারের ওপর অপরিবাহী আস্তরণ রয়েছে, যেন এটা ধাতব কোনো কিছুকে স্পর্শ করলেও "শর্ট সার্কিট" না হয়। চিত্রে দেখানো হয়েছে কোরের বাম পাশে একটা এসি ভোল্টেজের উৎস লাগানো হয়েছে। ভারটি যেহেতু লোহার কোরকে ঘিরে লাগানো হয়েছে তাই যখন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে তখন লোহার ভেতরে চৌম্বকত্ব তৈরি হবে এবং সেই চৌম্বক বলরেখা আয়তাকার লোহার ভেতর দিয়ে যাবে। 

                   

              চিত্র 12.13:  ট্রান্সফর্মার

আমরা যেহেতু এসি ভোল্টেজের উৎস লাগিয়েছি তাই লোহার কোরে চৌম্বকত্ব বাড়বে-কমবে এবং দিক পরিবর্তন করবে, অর্থাৎ ক্রমাগত চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হবে। লোহার কোরের অন্য পাশেও তার প্যাঁচানো আছে (অবশ্যই অপরিবাহী আবরণে ঢাকা) সেই কয়েলের মাঝে লোহার কোরের ভেতর দিয়ে চৌম্বক ক্ষেত্রটির ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকবে এবং এই পরিবর্তন ডান পাশের কয়েলে একটা তড়িচ্চালক শক্তি বা EMF তৈরি করবে একটা ভোল্টমিটারে আমরা সেটা ইচ্ছে করলে দেখতেও পারব। এই পদ্ধতিতে সরাসরি বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই একটি কয়েল থেকে অন্য কয়েলে বিদ্যুৎ পাঠানোর প্রক্রিয়াকে বলে ট্রান্সফর্মার। 

এই ট্রান্সফর্মার দিরে আমরা অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু বিষয় করতে পারি। দুই পাশে করেলের প্যাঁচসংখ্যা যদি সমান হয় তাহলে ৰাম দিকে আমরা যে এসি ভোল্টেজ প্রয়োগ করব ডান দিকে ঠিক সেই এসি ভোস্টেজ ফেরত পাব। ডান দিকে প্যাঁচের সংখ্যা যদি দশ গুণ বেশি হয় তাহলে ভোল্টেজ দশ গুণ বেশি হবে। প্যাঁচের সংখ্যা যদি দশ গুণ কম হয় তাহলে ভোল্টেজ দশ গুণ কম হবে। বাম দিকের কয়েল যেখানে এসি ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় তার নাম প্রাইমারি করেল বা মুখ্য কুণ্ডলী এবং ডান দিকে যেখান থেকে ভোল্টেজ ফেরত নেয়া হয় তার নাম সেকেন্ডারি কয়েল বা গৌণ কুণ্ডলী। 

তোমরা হয়তো মনে করতে পারো যদি সত্যি এটা ঘটানো সম্ভব হয় তাহলে আমরা প্রাইমারিতে অল্পসংখ্যক প্যাঁচ দিয়ে অল্প ভোল্টেজ প্রয়োগ করে, সেকেন্ডারি কয়েলে অনেক বেশি প্যাঁচ দিয়ে বিশাল একটা ভোল্টেজ বের করে অফুরন্ত বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবস্থা করে ফেলি না কেন? এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে প্রতি সেকেন্ডে কতটুকু বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেটা পরিমাপ করা হয় VI (ভোল্টেজ x কারেন্ট) দিয়ে, একটা ট্রান্সফর্মারে প্রাইমারিতে যে পরিমাণ VI প্রয়োগ করা হয় সেকেন্ডারি কয়েল থেকে ঠিক সেই পরিমাপ VI ফেরত পাওয়া যায়। কাজেই সেকেন্ডারিতে যদি ভোল্টেজ দশ গুণ বাড়িয়ে নেয়া যায় তাহলে সেখানে বিদ্যুৎত্ত দশ গুণ কমে যাবে। 

তোমাদেরকে বোঝানোর জন্য আয়তাকার একটি কোর দেখানো হয়েছে। সত্যিকারের ট্রান্সফর্মার একটু অন্যভাবে তৈরি হয়, সেখানে প্রাইমারির উপরেই সেকেন্ডারি কয়েল প্যাঁচানো হয় এবং কোরটাও একটু অন্য রকম হয়। 

প্রাইমারি করেলে প্যাঁচসংখ্যা যদি np এবং সেকেন্ডারি কয়েলের প্যাঁচসংখ্যা nsহয় তাহলে প্রাইমারি করেলে যদি এসি Vp ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় তাহলে সেকেন্ডারি করেলে যে এসি ভোল্টেজ Vs-পাওয়া যাবে তার পরিমাণ হবে 

Vs =nsnp×Vp

প্রাইমারি কয়েলে যদি Ip বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তাহলে সেকেন্ডারি কয়েলে বিদ্যুৎ প্রবাহ Is হবে 

Is=VpVs×Ip=npns×Is

যে ট্রান্সফরমারে প্রাইমারি কয়েলের তুলনায় সেকেন্ডারি কয়েলের প্যাঁচসংখ্যা বেশি হয় এবং সে কারণে প্রাইমারি করেলে প্রয়োগ করা এসি ভোল্টেজ সেকেন্ডারি কয়েলে বেড়ে যায় তাকে স্টেপ আগ ট্রান্সফরমার বলে। বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার ব্যবহার করে ভোল্টেজকে অনেক গুপ বাড়ানো হয়। 

যে ট্রান্সফরমারে প্রাইমারি কয়েলের তুলনার সেকেন্ডারি কয়েলের প্যাঁচসংখ্যা কম হয় এবং সে কারণে প্রাইমারি কয়েলে প্রয়োগ করা এসি ভোল্টেজ সেকেন্ডারি কয়েলে কমে যায় তাকে স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমার বলে। 

Content added By
Content updated By
Promotion